তেজস্ক্রিয়তা কাকে বলে ? বৈশিষ্ট্য , সূত্র , ব্যবহার ও ক্ষতিকর দিক

যে সকল মৌলের পারমাণবিক সংখ্যা ৮২ এর বেশি , তাদের পরমাণুর কেন্দ্রে অবস্থিত নিউক্লিয়াসকে দ্রুত গতির নিউট্রন দ্বারা আঘাত করলে নিউক্লিয়াস থেকে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে উচ্চভেদন ক্ষমতা সম্পন্ন বিকিরণ নির্গত হয় । মূলত এ ঘটনাকেই তেজস্ক্রিয়তা বলা হয় । এই টিউটরিয়ালে তেজস্ক্রিয়তা কি , তেজস্ক্রিয় মেীলের বৈশিষ্ট্য ,তেজস্ক্রিয় ক্ষয়ের সূত্র ও মৌলের অর্ধায়ু , এর ব্যবহার , ক্ষতিকর দিকসমূহ নিয়ে আলোচনা করা হবে । তাছাড়া আলফা , বিটা , গামা রশ্নির বৈশিষ্ট্য , তেজষ্ক্রিয়তার প্রতিকার ও চিকিৎসা নিয়ে ও আলোচনা করা হবে ।

তেজস্ক্রিয়তা

তেজস্ক্রিয়তা কাকে বলে ?

তেজস্ক্রিয়তা: ভারী মৌলিক পদার্থের নিউক্লিয়াস থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অবিরত আলফা, বিটা ও গামা রশ্মি নির্গমনের প্রক্রিয়াকে তেজস্ক্রিয়তা বলে । যে সকল মৌল হতে তেজস্ক্রিয় রশ্মি নির্গত হয় তাদেরকে তেজস্ক্রিয় মৌল বলে। প্রকৃতিতে প্রাপ্ত তেজস্ক্রিয় মৌলের সংখ্যা ১৪ টি। তেজস্ক্রিয়তার আবিষ্কারক ফরাসী বিজ্ঞানী হেনরী বেকরেল। তিনি তেজস্ক্রিয়তা আবিষ্কারের জন্য পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। তিনি সর্বপ্রথম ইউরেনিয়াম ধাতুর তেজস্ক্রিয়তা লক্ষ্য করেন ১৯৮৬ সালে। তিনি দেখতে পান যে, ইউরেনিয়াম ধাতুর নিউক্লিয়াস থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অবিরত বিশেষ ভেদন শক্তি সম্পন্ন রশ্মি বা বিকিরন নির্গত হয়। তার নামানুসারে এই রশ্মির নাম দেওয়া হয় বেকারেল রশ্মি। পরবর্তীতে মাদাম কুরি ও তার স্বামী পিয়ের কুরি ব্যাপক গবেষণায় দেখেন যে রেডিয়াম, পোলোনিয়াম, থোরিয়াম, আ্যক্টিনিয়াম প্রভৃতি ভারী মৌলের নিউক্লিয়াস থেকেও বেকরেল রশ্মির মত একই ধরনের রশ্মি নির্গত হয়, যা এখন তেজষ্ক্রিয় রশ্মি নামে পরিচিত।

ক) প্রাকৃতিক তেজস্ক্রিয় মৌল: পোলোনিয়াম, রেডন, ফ্রানসিয়াম, রেডিয়াম, অ্যাক্টিনিয়াম,থোরিয়াম, ইউরেনিয়াম ইত্যাদি ।
খ) কৃত্রিম বা সংশ্লেষিত তেজস্ক্রিয় মৌল: কৃত্রিম বা সংশ্লেষিত তেজস্ক্রিয় মৌল পরীক্ষাগারে কৃত্রিমভাবে নিউক্লিয় বিক্রিয়ার মাধ্যমে প্রস্তুত করা হয়। এ সকল মৌলের পরমাণবিক সংখ্যা ৯২- এর বেশি । যেমনঃ নেপচুনিয়াম, পুটোনিয়াম, রঞ্জেনিয়াম ইত্যাদি ।

তেজস্ক্রিয়তার বৈশিষ্ট্যসমূহ

তেজস্ক্রিয়তা একটি প্রাকৃতিক, স্বতঃস্ফূর্ত ঘটনা।
তেজস্ক্রিয়তা একটি অবিরাম ঘটনা, সবিরাম নয় ।
যে সকল মৌলের পরমাণবিক সংখ্যা ৮২-এর বেশি, সে সব পরমাণু তেজস্ক্রিয় ধর্ম দেখায়।
চাপ, তাপ, বিদ্যুৎ, চৌম্বক ক্ষেত্র বা বাইরের কোন বল দ্বারা তেজস্ক্রিয়তা প্রভাবিত হয় না।
তেজস্ক্রিয়তা একটি সম্পূর্ণ নিউক্লিয় ঘটনা।
নিউক্লিয়াসের ভাঙনের ফলে একটি মৌল আর একটি নতুন মৌলে রূপান্তরিত হয়।

তেজস্ক্রিয় ক্ষয়ের সূত্র ও মৌলের অর্ধায়ু

তেজস্ক্রিয় ক্ষয়ের সূত্র:
কোন মুহূর্তে তেজস্ক্রিয় পরমানুর ভাঙ্গার বা ক্ষয়ের হার ওই সময়ে অক্ষত পরমাণুর সমানুপাতিক ।
১৮৯৮ সালে মাদাম কুরি ও পিয়ারে কুরি তেজস্ক্রিয় ধাতু থোরিয়াম আবিষ্কার করেন।
তেজস্ক্রিয়তার একক: তেজস্ক্রিয়তার দুটি একক রয়েছে। যথা- ক) কুরী খ) বেকরেল।
রেডিয়াম ধাতু তেজস্ক্রিয়তার ফলে ধাপে ধাপে পরিবর্তিত হয়ে শেষে সীসাতে পরিণত হয় ।

তেজস্ক্রিয় মৌলের অর্ধায়ুঃ
যে সময়ে কোন তেজস্ক্রিয় পদার্থের মোট পরমাণুর ঠিক অর্ধেক পরিমাণ ক্ষয়প্রাপ্ত হয়, তাকে ঐ পদার্থের অর্ধায়ু বলে। উদাহরণস্বরূপ ধরা যাক, কোন মৌলে 100,000 টি তেজস্ক্রিয় পরমাণু আছে। 100,000 টি পরমাণু অর্ধেক হতে অর্থাৎ 50,000 টি পরমাণু ক্ষয় পেতে 768 কোটি বছর সময় লাগে । অতএব মৌলের অর্ধায়ু 768 কোটি বছর।
ইউরেনিয়ামের অর্ধায়ু 450 কোটি বছর: 1 গ্রাম ইউরেনিয়াম পরমাণু ক্ষয় পেয়ে ঠিক অর্ধেক অর্থাৎ 1 2 গ্রাম হতে 450 কোটি বছর সময় লাগে ।
Carbon-14 রেডিও আইসোটোপের অর্ধায়ু: 5568 বছর।

তেজষ্ক্রিয়তার ব্যবহার

তেজস্ক্রিয়তা বহুবিধ কাজে ব্যবহৃত হয়। যেমন-
১. চিকিৎসা বিজ্ঞানঃ দুরারোগ্য ক্যানসার রোগ নিরাময়ে তেজস্ক্রিয়তা ব্যবহৃত হচ্ছে। রোগ নির্ণয়ের কাজেও তেজস্ক্রিয় প্রদর্শককে (Radioactive tracer) সফলতার সাথে কাজে লাগানো হচ্ছে।
২. কৃষিক্ষেত্রেঃ উন্নত বীজ তৈরির গবেষণায়।
৩. শিল্প কারখানাতেও তেজস্ক্রিয়তা ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
৪. খনিজ পদার্থে বিভিন্ন ধাতুর পরিমাণ নির্ণয়ে উক্ত ধাতুর তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ (Isotope), তেজস্ক্রিয় প্রদর্শক হিসেবে বহুল ব্যবহৃত হচ্ছে।
৫. পরমাণুর গঠন নির্ণয় এবং পরমাণুর কৃত্রিম ভাঙ্গনে ।
৬. নতুন মৌল পদার্থ আবিষ্কারে - তেজস্ক্রিয়তার ব্যবহার রয়েছে ।

তেজস্ক্রিয় আইসোটোপের ব্যবহার

তেজস্ক্রিয় (Radio) আইসোটোপ: যে সমস্ত আইসোটোপ তেজস্ক্রিয় ধর্ম প্রদর্শন করে, তাদের তেজষ্ক্রিয় বা রেডিও আইসোটোপ বলা হয়। যেমনঃ রেডিয়াম, ইউরেনিয়াম, প্লুটোনিয়াম ইত্যাদি । নিচে তেজস্ক্রিয় আইসোটোপের ব্যবহার উল্লেখ করা হল ।

১) চিকিৎসাক্ষেত্রে:
কোবাল্ট-60 ( 60 Co ) আইসোটোপ হতে নির্গত গামা রশ্মি ক্যান্সার, টিউমার প্রভৃতি রোগ নিরাময়ে ব্যবহৃত হয়।
শরীরের কোন স্থানে ক্যান্সার, টিউমার প্রভৃতির উপস্থিতি তেজস্ক্রিয় আইসোটোপের দ্বারা নির্ণয় করা যায়।
গলগণ্ড রোগ নির্ণয় ও থাইরয়েড গ্লান্ডের বিভিন্ন রোগের চিকিৎসায় আয়োডিন-131 ( 131 I ) ব্যবহৃত হয়।
ব্লাড ক্যান্সারের চিকিৎসায় ফসফরাস-32 ( 32 P ) ব্যবহৃত হয়।
২) কৃষিক্ষেত্রে :
কীটপতঙ্গ ধ্বংসে ব্যবহৃত হয়।
উন্নত বীজ উদ্ভাবন ও বীজ সংরক্ষণ ব্যবহৃত হয়।
৩) বয়স নির্ধারণে কার্বন-14 আইসোটোপ ব্যবহৃত হয়।
৪) গবেষণাকার্যে ও শিল্প বিজ্ঞানে রেডিও আইসোটোপের ব্যবহার রয়েছে।

তেজষ্ক্রিয়তার ক্ষতি

তেজস্ক্রিয়তা মানবদেহে বিভিন্ন রকম ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। যেমন-
মানবদেহে নানা রকম ক্যানসারের জন্ম দিতে পারে।
মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস করে।
মানসিক বিকার এমন কি বিকলাঙ্গতা ও সৃষ্টি হতে পারে।
তেজস্ক্রিয়তার ক্ষতিকর প্রভাব বংশ পরস্পরায়ও পরিলক্ষিত হয়।
তেজষ্ক্রিয় বর্জ্য পদার্থ মানব সভ্যতার জন্য হুমকি স্বরূপ।
কোন রশ্মি জীবজগতের জন্যে সবচেয়ে ক্ষতিকারক: গামা রশ্মি।

গামা রশ্মির ক্ষতিকর দিক:
১. এ রশ্মি শরীরে পড়লে ত্বক নষ্ট হয়ে যায়, মাথার চুল পড়ে যায় ।
২. এ রশ্মির প্রভাবে ক্যান্সার ও টিউমার হতে পারে ।
৩. ক্রমাগতভাবে এ রশ্মি দেহে পড়লে মানুষের মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে ।

আলফা , বিটা ও গামা রশ্মির বৈশিষ্ট্য

আলফা ( α ) রশ্মির বৈশিষ্ট্য:
১. এটি একটি হিলিয়াম নিউক্লিয়াস বা দ্বি-আয়নিত হিলিয়াম পরমাণু।
২. এর ভর হাইড্রোজেন পরমাণুর চার গুণ।
৩. আলফা রশ্মি ধনাত্মক আধানযুক্ত। এর আধান 3.2× 10 -19 C.
৪. স্বাভাবিক চাপ ও তাপমাত্রায় কয়েক সেন্টিমিটার বায়ু বা ধাতুর পাতলা শিট দ্বারা এর গতি থমকে দেওয়া যায়।
৫. এই রশ্মি চৌম্বক ও তড়িৎ ক্ষেত্র দ্বারা বিচ্যুত হয় ।
৬. কণাধর্মী, তরঙ্গ দৈর্ঘ্য নেই।
৭. এই ভর বেশি হওয়ায় ভেদন ক্ষমতা কম ।
৮. এই রশ্মি তীব্র আয়নায়ন সৃষ্টি করতে পারে। β রশ্মির তুলনায় 100গুণ; γ রশ্মির তুলনায় 1000গুণ বেশি।
৯. এই রশ্নি ফটোগ্রাফিক প্লেটে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।
১০. এই রশ্নি জিংক সালফাইভ পর্দায় প্রতিপ্রভা সৃষ্টি করে ।

বিটা ( β ) রশ্মির বৈশিষ্ট্য:
১. এই রশ্মি অতি উচ্চ দ্রুতি সম্পন্ন ইলেকট্রনের প্রবাহ।
২. এর ভর ইলেকট্রনের সমান অর্থাৎ 9.11 × 10 -31 Kg ।
৩. বিটা রশ্মির ঋণাত্মক আধানযুক্ত। এর আধান +1.6×1 10 -19 C
৪. এই রশ্মি চৌম্বক ও তড়িৎ ক্ষেত্র দ্বারা বিক্ষিপ্ত হয়।
৫. এর ভেদন ক্ষমতা আলফা রশ্মির চেয়ে বেশি।
৬. এই রশ্মি অত্যন্ত দ্রুত নির্গত হয় । এর দ্রুতি আলোর দ্রুতির শতকরা ৯৮ ভাগ হতে পারে।
৭. ফটোগ্রাফিক প্লেটে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।
৮. এরা গ্যাসকে আয়নিত করে, আলফা রশ্মির অপেক্ষা কম ।

গামা ( γ ) রশ্মির বৈশিষ্ট্য:
১. এর কোন ভর ও চার্জ নেই ।
২. এটি তড়িৎ চুম্বকীয় তরঙ্গ। এই রশ্মি তড়িৎ ও চৌম্বক ক্ষেত্র দ্বারা বিচ্যুত হয় না।
৩. এর তরঙ্গ দৈর্ঘ্য খুবই ক্ষুদ্র, তাই শক্তি খুব বেশি ।
৪. আলফা ও বিটা রশ্মির চেয়ে এই রশ্মির ভেদন ক্ষমতা অনেক বেশি।
৫. এর দ্রুতি আলোর সমান অর্থাৎ 3× 10 8 m/sec.
৬. ফটোগ্রাফিক প্লেটে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে ।

তেজষ্ক্রিয়তার প্রতিকার ও চিকিৎসা

প্রখর সূর্যকিরণে বাহিরে যাওয়া থেকে বিরত থাকা।
যতটুকু সম্ভব বৃষ্টির জলকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করা।
ক্লোরোফিল ও অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ খাদ্য গ্রহণ করা।
আয়োডিনযুক্ত লবণ খাওয়া ।
দিনের বেলায় বাহিরে বের হলে সান-গ্লাস ব্যবহার করা।
বিভিন্ন রেডিয়েশন থেরাপি অতিমাত্রায় গ্রহণ না করা।
এক্স-রে ও রেডিয়েশন হয় এমন সব মেশিন থেকে দূরে থাকা।
দিনের বেলায় বাহিরে বের হলে শরীর ঢেকে রাখা বা সান-লোশন বা ক্রিম ব্যবহার করা।

নবীনতর পূর্বতন